পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় যখন করোনার ভাইরাস বা কোভিড১৯ এর ভ্যাকসিন বানাতে ব্যাস্ত, উগান্ডার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কি করছে তখন?
পুরো পৃথিবীটিই এখন থমকে গিয়েছে করোনা ভাইরাস মহামারিতে। এবারই প্রথম নয়, বহুবার এমন মহামারি এসেছে পৃথিবীতে এবং অনেকবার থমকে গিয়েছে আংশিক অথবা সম্পূর্ণ পৃথিবীটি।
কিন্তু প্রতিবার ই মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায়, তার তৈরি ভেজষ-নন ভেজষের বিভিন্ন মিশ্রণ দিয়ে নানা প্রকারের ঔষধ অথবা ভেকসিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানিরা। যেটার মাধ্যমে মানব জাতি এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছে ।
এবারের মহামারির মূল নিয়ামক কোভিড১৯ ভাইরাস যেটা সব ভাইরাস এর তুলনায় সম্পুর্ন আলাদা এবং খুবই শক্তিশালী । প্রতিবারের মত এবারও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাসের ঔষধ অথবা ভেকসিন আবিস্কার নিয়ে দিন-রাত কাজ করছেন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় গুলো হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান, কলা-সাহিত্য চর্চার প্রধান স্থান। আর পৃথিবী জুড়ে যে কোন সমস্যার সমাধানের গুরু দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের উপর।
কিন্তু পুরো পৃথিবীতে একটি মাত্র দেশ উগান্ডা, যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে করোনা নিয়ে গবেষনা তো দূরের কথা , গবেষনার ধারের কাছেও কিছু করা হচ্ছে না। যেখানে সমস্যা সমাধানে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের কাজ করার কথা, উল্টে সেখানে এমন কিছু কাজ করা হচ্ছে যেখানে নতুন করে আর বেশি সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
পৃথিবীতে উগান্ডাই এক মাত্র দেশ, যেখানে বিশ্ববিদ্যাল গুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞান এর মালিক সেখান কার বড় হুজুর রা। বড় হুজুর এর বিপক্ষে সেখানে কিছু বললেই চাকরি চলে যায়। আমাডেড় বাঞলাডেশ থেকে উগান্ডার শিক্ষা নেয়া উচিৎ। ট্রেইনিং নেয়া উচিৎ কিভাবে সময় কে কাজে লাগাতে হয় আর বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।
যাই হোক, করোনা ভাইরাস এর মহামারিতে উগান্ডার শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা কি করছেন অথবা কিভাবে তাদের মূল্যবান সময় অতিক্রম করছেন চলুন সেটা জেনে নেওয়া যাক। এই আর্টিকেল এ যদি কোন তথ্যগত ভুল থাকে, তাহলে কমেন্ট করতে পারেন, পরবর্তী আপডেটে জানিয়ে দেওয়া হবে।
প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক উগান্ডার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলিগন যা যা করছেনঃ
১। সফটয়্যার ইনিস্টলেশন এবং সেইটার ব্যবহার বিধিঃ শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকেই ভাবছেন যে, এটা আবার কেমন কাজ এবং এইগুলোর সথে কোভিড১৯ এরই বা কি সম্পর্ক ?
আর কম্পিউটার প্রকৌশল এর বাইরের টিচারদের তো খুব বেশী সফটয়্যার লাগার কথা না তাহলে তারা কি করছেন? আবার ব্যবহার বিধিও বা আলাদা কেন এখানে ?
প্রথমত উগান্ডা হচ্ছে পৃথিবীর সেই জাতি যাদের কাছে নিজের স্বার্থের বাইরে বৃহত্তর স্বার্থ বলে আর কিছুই নাই। পৃথিবী উল্টে গেলেও এখানে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস এবং পরীক্ষা দুটাই সচল থাকবে। এমন কি যদি ৪০% শিক্ষার্থীর সমস্যা থাকে তারপরও রীতির কোনো পরিবর্তন হবে না ।
যেখানে সকলের শ্রদ্ধ্যেয় শিক্ষকমন্ডলির দরকার টাকা আর শিক্ষার্থীদের দরকার হাই সিজিপিএ যুক্ত সার্টিফিকেট । এই সার্টিফিকেটের পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে শিক্ষার্থীদের কাছে কি শিখলাম না শিখলাম সেটা ম্যাটার নাহ। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেমিস্টারগুলোকে শেষ করা। পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এটাই আসল কথা ।
অনলাইনে ক্লাস নেয়ার জন্য লাগে জুম, টিম, মেট, ইমো, ভাইভাব, হোয়াটস-এপ ইত্যাদি অ্যাপের অনেক জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে বর্তমানে। যাই হোক এইবার আর ফেসবুকের নাম বললাম না, কারন ফেসবুক নিয়ে কথা বলে এর আগের বার কট খাইছিলাম। মার্ক মামু আমার আইডি খাইয়া দিছিল আর কি। লোল।
উগান্ডাতে বর্তমানে কয়েক লাখ সিএসই গ্র্যাজুয়েট থাকলেও এবং প্রতি সেমিস্টার এ কয়েক শত সিএসই শিক্ষার্থী বের হলেও তাদের নিজেদের কোন ইনোভেশন থাকবে না। এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের কথা হচ্ছে, “আমরা যদি ইনোভেটিভ সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করি, তাহলে ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার , পয়েন্ট অফ সেল প্রজেক্ট কে করবে?”
উগান্ডার শ্রদ্ধ্যেহ শিক্ষকমন্ডলির মধ্যে অনেকে এতই মর্ডান যে, মেনুয়াল দেখে দেখে তাদের সফটওয়্যারে ব্যাবহার শিখতে হচ্ছে। ইউটিউবে যে টিউটোরিয়াল পাওয়া যায় সেটা বইলেন না আবার। তবে ইউটিউব এর মাধ্যমে ক্লাস নেয়া গেলে দয়া করে জানাবেন।
এবার আসি উগান্ডার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধ্যেয় শিক্ষকমন্ডলিদের কথায়, তারা যা যা করছেন একটু জেনে নেওয়া যাকঃ
১। মহামারিতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রাখার পক্ষে মতামতঃ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, উগান্ডার অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমন্ডলি গণ মহামারিতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের পক্ষেই তাদের মতামত পোষন করেছেন ।
এমনি সময়ে তো ক্লাস এ গিয়ে গাল-গপ্প আর অযাচিত, অতীত আমলের লেকচার দিয়ে বেতন নিতে হয় কিন্তু লক-ডাউনে দৌলতে তো সেটারও কোনো প্রয়োজন নেই । ফ্রিতে ঘরে বসে বসেই মাসে মাসে ঠিক সময়ে তাদের বেতন পায়ে যাচ্ছেন । এই সুযোগ ছেড়ে দেয়ার পক্ষে তাড়া নয়।
পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যেখানে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন, পেপার পাবলিশ করছেন সেখানে উগান্ডার শ্রদ্ধ্যেয় শিক্ষকমন্ডলিগণ কাটাচ্ছেন জীবনের দীর্ঘতম ছুঁটি।
২। অবৈজ্ঞানিক গবেষনাঃ বিজ্ঞান গবেষোণার একটা প্রক্রিয়া আছে এবং যেটাতে যথেষ্ট সময় লাগে। স্পেশালি একটা গবেষনা কতটা কার্যকরি হবে, সেটা বুঝতে অন্য বিজ্ঞানিদের সাইটেশন এর উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু উগান্ডাতে যেটা হয় সেটা হলো, একটা কিছু করলেই সেটা চলে যায় নিউজ সাইটগুলোতে। যার নিউজ যত বেশি ভাইরাল, সে তত বড় গবেষক।
এর সাথে তো আছেই, নন-সেন্স সব গবেষণার উদাহরণ। কিছুদিন আগে উগান্ডার এক বিজ্ঞানি “বিড়াল এর বিহেবিয়ারাল জিন”সনাক্ত করলেন। যেটা পুরা উগান্ডাই ভাইরাল হয়ে গেল। কিন্তু এই জিন দিয়ে পরবর্তীতে কি হবে, কি কাজে লাগবে, কেনই বা সেই জিন বের করা হলো, সেটার কিছুই জানা হলো না এবং সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথাও নেই।
এখন আসি শিক্ষার্থীদের কথাই উগান্ডা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কি করছেন এই পরিস্থিতিতেঃ
১। ফেসবুক গেইমঃ ফেসবুক ভিত্তিক যে কত রকম গেইম আছে সেটা আপনি উগান্ডাতে না গেলে বুঝতেই পারবেন না! আই মিন উগান্ডার শিক্ষার্থীদের সাথে ফেবু তে এড না থাকলে বুঝতে পারবেন না। তাদের কোনো পোস্ট আপনার খুব ভালো লাগছে?? ভুলেও রিয়েক্ট দিতে যাবেন না। এটা একটা ফাদ, যদি একবার রিয়েক্ট দেন, আপনি শেষ।
আপনার ইনবক্সে ম্যাসেজ চলে আসবে। সেখান থেকে কিছু একশন এর পর আবার কিছু কাজ করা লাগবে। তার পর আবার কিছু। সেগুলা করতে গিয়ে যদি ভূলে কোথাও আবারও কোথাও রিয়েক্ট পরে যায় ,তাহলে আবার বিপদ। চেইন রিয়েকশন চলতেই থাকবে।
এগুলোর সাথে আছে, কমেন্ট করা, অমুকের ব্যাপারে বলা, নাম না বলে কথা বলার মত গেইম গুলো। কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা আরও এক ধাপ এগিয়ে, তারা আবার নাম হাইড করে কমেন্টস গ্রহন করে থাকে।
এসব জায়গাতে যদি আপনি ভালো মেসেজ দেন, তবে মিষ্টি করে কথা বলেন, তাইলে আপনার ম্যাসেজ এর স্ক্রিনশর্ট সেই ব্যাক্তির ডে তে বা নিউজফিডে দেখার সৌভাগ্য হবে । কিন্তু খারাপ কিছু বললে জীবনেও সেটা প্রকাশ পাবে না।
২। ফেসবুক গ্রুপ এবং লাইভঃ উগান্ডার সাধারন ছুটির পর পর ই শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সবাই অন্তত কমপক্ষে ১হালি (পড়ুন ৪টি) করে ফেসবুক গ্রুপ খুলবে আর নূন্যতম একটা ফেসবুক লাইভ করবে। কিন্তু পরবর্তীতে নিয়ম ভংঙ্গ করে সবাই অন্তত ১ডজনের ও বেশি ফেসবুক গ্রুপ খুলেছে।
ফেসবুক গ্রুপ খোলার পর মানুষকে গনহারে এড দেয়াটি হচ্ছে গুরু দায়িত্ব। রিলেভেন্ট থাকুক বা না থাকুক, কেউ আগ্রহী থাকুক বা না থাকুক, সমানে ফেসবুক গ্রুপ এ এড দিয়েই যাবেন। এটা হচ্ছে উগান্ডার শিক্ষার্থীদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য।
উগান্ডার শিক্ষার্থীদের চোখে প্রচন্ড পাপ, তাই তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রুপ হচ্ছে, “পাপী চোখে যা যা দেখেছি গ্রুপ”, তার পর পাবলিক ভার্সেস প্রাইভেট মারামারি চাই, ১-৯ এর কম্বিনেশন-পার্মুনেশন এ যত ক্লাস হবে সব গ্রুপ এর কথা না বললে মান থাকে না।
লাইভ ভিডিও এর কথা আর কি বলবো। এটা নিয়ে কিছু বললে আবার বড় হুজুর রাগ করতে পারেন। তাই না বলাটাই শ্রেয় । তবে এই ব্রেক এ ফেজবুক লাইভ না থাকলে, এত গুলো করোনা বিশেশ-অজ্ঞদের যে কি হত সেটাও গবেষণার বিষয়।
৩। করোনার নিউজ শেয়ার দেয়াঃ ব্রেক এর সময়টা তে উগান্ডার শিক্ষার্থীদের অনেকগুলি কাজের মাঝে অন্যতম হচ্ছে , করোনার নিউজ শেয়ার দেয়া। আপনার পোস্ট এ যদি কোন ভাবে করোনা নিয়ে লেখা থাকে, সাথে সাথেই সেটা ভাইরাল হয়ে যাবে শেয়ারের মধ্যমে।
নিউজ এর সত্যতা যাচাই দূরে থাক, কেউ পড়েও দেখবে না। কারন কোনো নিউজ পড়ে সত্যতা যাচাই করার মতো এতো সময় উগান্ডর শিক্ষার্থীদের কাছে নেই। এর বাইরেও তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছ।
উগান্ডার ফেসবুকে আপনি করোনা বিষয়ে যত জ্ঞান পাবেন আর যত সাজেশন পাবেন। সেটা বাদ বাকি পুরো ওয়ার্ল্ড এর জ্ঞান কে একত্র করলেও ১০% ও হবে না। একটা শিক্ষার্থী সমাজ কতটা এগিয়ে গেলে এ রকম নিউজ শেয়ার করতে পারে, সেটা আপনি নিজেই চিন্তা করে দেখুন।
৪। অনলাইন আড্ডা আর লুডুঃ উগান্ডায় আপনি এমন শিক্ষার্থী খুব কমই খুঁজে পাবেন, যারা এই লক-ডাউনের সময়ে লুডু খেলে বা অনলাইন আড্ডা দিয়ে তার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছেন না । এখানকার শিক্ষার্থীরা ক্লাস না থাকলে আড্ডা দেয়, আর ক্লাস থাকলে সেটা বাং দিয়ে আড্ডা দেয়। অনলাইনে আড্ডা দেয়ার পর প্রথম কাজ হচ্ছে সেটা স্ক্রিনশর্ট দিয়ে মাই ডে তে দেয়া।
৫। স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠানঃ উগান্ডার শিক্ষার্থীরা ব্রেক-ডাউন শুরুর পর থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রত্যেকেই অন্তত ১টা করে হলেও স্টার্ট-আপের ফাউন্ডার হবে। অনেকে অবশ্য একাধিক স্টার্ট-আপ ফাউন্ডিং করে ফেলেছে। আসলে উগান্ডায় স্টার্ট-আপ ফাউন্ডার হওয়া পানির মত সহজ।
প্রথমে আপনি একটা পেইজ খুলবেন। একটা পিকচার আপলোড দিবেন, গনহারে সবাইকে ইনভাইট করবেন আর তার পর আপনি প্রফাইলে ফাউন্ডার অথবা সিইও লাগাবেন। আর যদি প্রো-লেভেল হতে চান, তাইলে জাস্ট একটা ডোমেইন-হোস্টিং নিয়ে একটা থিম ইনস্টল দিবেন।
উগান্ডার থিম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির ওয়েব সাইট চলে ফ্রি/ক্র্যাক থিম দিয়ে। অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিগুলোতে তাদের কোন নিজস্ব অ্যাপস নেই।
এত কিছু করার পর কি আর গবেষণা করার সময় থাকে, আপনিই বলুন ? আর গবেষণা করেই বা কি লাভ? তার পরও কিছু লোক স্রোতের উল্টো দিকে গিয়ে রিসার্চ করে, উগান্ডা নিয়ে আশাবাদি হয় এবং উগান্ডাকে চেঞ্জ করে সিজ্ঞাপুর বানানোর স্বপ্ন দেখে।
অন্য দেশের মত উগান্ডায়ও অনেক ভালো শিক্ষক আছে যারা গবেষনা করে যাচ্ছেন নিরলস ভাবে, যারা কাজ করে যাচ্ছেন রাত দিন। অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা ইনোভেটিভ কাজ করছেন। তারা এক্সসেপশনাল। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
কাল্পনিক রাইটার,
রউফুল আলম,
উগান্ডা, ২০৫০