০১
আমার বিরুদ্ধে একটা এলিগেশন হচ্ছে ডিমোটিভেশন। আমার কথা বার্তা অনেকের পছন্দ হয় না। অনেকে ডিমোটিভেট হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমি জেনে বুঝে, শিক্ষার্থীদের ডিমোটিভেট করি। বিশেষ করে, প্রথমবার কথা বলার সময় আমি, প্রচন্ড ভয় দেখাই আর ডিমোটিভেট করি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এর কারন কি? আমি নিজে কম্পিউটার বিজ্ঞান এর ছাত্র হয়ে অন্যদের কেন উৎসাহ দেই নাহ? পুরো ব্লগটি যথেষ্ট বড় তাই ধৈর্য নিয়ে পড়ুন। যদি এই রকম লম্বা ব্লগ না পড়তে পারেন, তাহলে সিএসই পড়া বাদ দিন। সিএসই ইজ নট ফর ইউ।
০২
কম্পিউটার বিজ্ঞান হচ্ছে অসাধারন ক্রিয়েটিভ একটা সাবজেক্ট। যে সব সাবজেক্ট ট্রেন্ডিং এ আছে তাদের মধ্য কম্পিউটার সাইন্স অন্যতম।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড কম্পিউটার সাইন্স এ যে পরিমান রিসার্চ ফান্ডিং হয় যেটা বাকি সাবজেক্ট এর তুলনায় অনেক অনেক বেশী। শুধু কোর কম্পিউটার সাইন্স নয়, অন্য সাবজেক্ট গুলোতেও কম্পিউটারাইজড রিসার্চ হয়। এই জন্য যারা রিসার্চার হতে চায়, তাদের জন্য সিএসই হচ্ছে ওয়ান অফ দ্যা বেস্ট চয়েজ।
ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশন, যেটা অটোমোশনের কথা বলা হচ্ছে, মেশিন লার্নিং বেইজড সব কিছু হবে। এই রেভুলেশনের একবারে ফ্রন্ট লাইনে আছে কম্পিউটার বিজ্ঞানিরা। বলতে গেলে, কম্পিউটার বিজ্ঞানিদের অবদানের উপর নির্ভর করছে এই রেভুলেশন।
কম্পিউটার সাইন্স এতটাই গুরুত্বপুর্ন যে, অন্যান্য সাবজেক্ট এ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, মেশিন লার্নিং এর মত সাবজেক্ট পড়ানো হচ্ছে। রিসার্চ বা প্রজেক্ট এ কম্পিউটার ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। উগান্ডা বাদে বাদ বাকি বিশ্বে, কম্পিউটার স্কিল্ড পার্সন এর চাহিদা আকাশ সমান।
চাকরির ক্ষেত্রে, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সারা বিশ্বের দরজা খোলা। পড়া শেষে দেশে চাকরি না পেলে বিদেশে কাজ করা যায়। রিমোট চাকরিতে, দেশে বসে ওয়ার্ল্ড এর যে কোন প্রান্তে চাকরি করা যায়। উগান্ডাতেও ছোট বড় অনেক ডেভেলপমেন্ট ফার্ম রয়েছে।
নিজে কিছু করতে চাইল, ছোট করে একাই শুরু করা সম্ভব। একটি কম্পিউটার আর ক্রিয়েটিভ আইডিয়া দিয়ে একাই বানিয়ে ফেলা যায় মিলিয়ন ডলার এর প্রজেক্ট। রয়েছে ফ্রিল্যান্সিং এর সুযোগ।
ভালো রেজাল্ট করলে একাডেমিক চাকরি, বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ। খারাপ রেজাল্ট করলে, মাইক্রসফট-ফেজবুকের দরজা খোলা। মানে সিএসই ভর্তি হলেই আর চিন্তা নেই। ফিউচার সোনায় সোহাগা।
খারাপ রেজাল্ট করে, প্রচুর ফেইল করে, কিছু না পড়ে ডিগ্রি ছাড়াই টেক যায়ান্ট কোম্পানিতে চাকরি করার প্রচুর উদাহরন রয়েছে। আছে রিমোট জব করে দেশে বসে বিদেশি ডলার কামানোর উদাহরন। ফ্রিল্যান্সার থেকে উদোক্তা হওয়ার গল্প কম নেই।
০৩
এইচএসই পড়ুয়া বা সদ্য পাশ করা যে কাওকে ০২ এর তথ্য গুলো বলে মোটিভেট করা যায়। তথ্য গুলো সত্যিও। আমাদের সিনিয়র রা হর-হামেশা এগুলা বলেই ছেলে মেয়েদের মোটিভেট করে।
ব্যাক ল্যাগ সহ মনির ভাই (মাইক্রসফট) এর উদাহরন এর পপুলারিটি এমন পর্যায়ে গেছে যে, সেটা গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড দাবি করে। হালের নতুন ট্রেন্ড ফ্রিল্যান্সিং এর কথাও ঢালাও ভাবে প্রচার করা হয় সিএসই সাবজেক্ট রিভিউ তে।
উগান্ডাতে এই কথা গুলোর প্রচার এত বেশী হয়েছে যে, সিএসই তে ভর্তি হওয়া এখন ট্রেন্ডিং। এইচএসই পাশ করার পর প্রচুর ছেলে-মেয়ে সিএসই তে ভর্তি হয়। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ সিএসই গ্র্যাজুয়েট বের হয় উগান্ডাতে।
০৪
কমিউনিটিতে কাজ করার জন্য, প্রচুর ছেলে মেয়ের সাথে আমি কানেক্ট হতে শুরু করি এক সময়। এবং তাদের অনেকের গল্প, হতাশার চিত্র আমি জানতে পারি। উগান্ডার সিএসই পাশ করুয়া প্রচুর গ্র্যাজুয়েট আছেন যারা এতটাই হতাশ যে, সামনের দিন গুলোতে কি করবেন সেটাও আইডিয়া নেই।
রানিং সিনিয়র শিক্ষার্থীরা জানে না, কি করতে চায়, কি করা উচিৎ। অনেকে হতাশ হয়ে সাইকোলজিস্ট এর কাছেও যেতে দেখি প্রতিনিয়ত।
আমি সমস্যার মুল খুজতে শুরু করি। আমার শুরুতে মনে হয়েছিল, পর্যাপ্ত তথ্যর অভাবে ছেলে মেয়েরা হতাশ। তথ্য শেয়ার করার জন্য আমার ব্লগ, ইউটিউব চ্যানেল গালিব নোটস এবং ফেজবুক গ্রুপ শুরু করি।
এই সব চ্যানেলের কল্যানে আমি আরও অনেক ছেলে মেয়ের সাথে প্রতিনিয়ত কানেক্টেড হচ্ছি। একটা সময়ে আমি রিয়েলাইজ করি, তথ্যর অভাবের থেকেও বড় সমস্যা হচ্ছে, না বুঝে সিএসই তে ভর্তি হওয়া। প্রচুর ছেলে মেয়ে সিএসই তে ভর্তি হয় যাদের ৯৮% জানেই না কেন ভর্তি হচ্ছে আর ফিউচার কি।
এই যে এত স্টুডেন্ট ভর্তি হয়, এর মুল কারন হচ্ছে, ০২ এর আজাইরা মোটিভেশন।
০৫
দেখুন, ০২ এ বলা সব তথ্য সম্পুর্ন সঠিক কিন্তু সম্পুর্ন নয়। মোনির ভাই এর যে গল্প লেখা হয় সেখানে শুধু তার সাফল্যর কথা বলা হয়। কিন্তু মনির ভাই যে কত সময় কোড লিখেছেন বা কিভাবে তিনি প্রস্তুত করেছেন সেটা কোথাও লেখা হয় না।
যদি কেউ কোড লিখতে লিখতে একটা সাবজেক্ট এ ব্যাক-ল্যাগ খায় তাহলে সেটা এবসলুটলি সঠিক। কিন্তু ফেজবুক চালিয়ে, রাত জেগে গল্প করে ব্যাক-ল্যাগ খাইলে সঠিক নয়। যদি স্কিল ডেভেলপমেন্ট এ সময় দিতে দিতে ক্লাস কিছুটা মিস যায় সেটা ঠিক আছে কিন্তু টুর এর জন্য মিস দিলে সমস্যা।
সমস্যা হচ্ছে, আজাইরা মোটিভেশনে শুধু সাক্সেস পার্ট টাই বলা হয় কিন্তু সাক্সেস এর পিছনে যে কত ত্যাগ, পরিশ্রম সেটা বলা হয় না। এতে করে শিক্ষার্থীরা ভাবে, সিএসই ভর্তি হলেই, সাক্সেস চলে আসবে। কিছু না করেও বড় কিছু করা যাবে।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, বাই ন্যাচার কম্পিউটার সাইন্স সবার জন্য নয়। এখানে যদি কেউ বুঝে তাহলে দুনিয়ার সব যায়গা কাজ আছে আর যদি না বুঝে তাইলে কোথাও নেই।
একজন স্টুডেন্ট যদি বিবিএ-এমবিএ করে বড় কোম্পানিতে জব না পায়, তাহলে রেস্টুরেন্ট এর একাউন্টেন্ হতে পারে। কিন্তু যদি একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং না পারে, তাহলে কি সফটয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে?
আমাদের দেশে প্রচুর ছেলে মেয়ে আছে যারা বিবিএ করে জব পায় না, এমবিএ করে। এমবিএ করে জব পায় না তখন ডাবল এমবিএ করে। তার পরও জব না পেলে রেস্টুরেন্ট এর একাউন্টেন্ট হয়। ডাবল এমবিএ করে প্রচুর ছেলে মেয়ে অড জব করে। কিন্তু প্রোগ্রামিং বা কোডিং না পেরে সফটয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার উদাহরন একটাও নেই।
এখানেই হচ্ছে, বাই ন্যাচার এর ব্যাপার চলে আসে। যদি পারেন, স্কিল্ড হন তাহলে ১০০ তে ১০০ আর যদি না পারেন তাহলে ১০০ তে সরাসরি ০০০। মাঝে কিছু নেই। এ কারনে সিএসই তে অনেক বাজে রেজাল্ট নিয়ে অনেকে যায়ান্ট কোম্পানিতে জব পায়।
০৬
সিএসই পড়ার জন্য যথেষ্ট শেলফ কনফিডেন্ট থাকা দরকার।
একজন ফার্মেসি এর শিক্ষার্থী পাশ করার পর চাকরি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন সিএস এর শিক্ষার্থী পাশ করার আগে চাকরতে ঢুকতে পারে, আবার পাশ করার পরেও। চাইলে ফ্রিল্যান্সিং করতে পারে। নিজস্ব স্টার্ট-আপ দিতে পারে, হতে পারে ট্রেইনার।
চাকরিতে রয়েছে হাজার রাস্তা। এত এত রাস্তার মাঝে নিজের প্ল্যান এ কাজ করে যাওয়ার জন্য প্রচন্ড সেলফ কনফিডেন্ট দরকার। না হলে রাস্তা হারানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। যেটা হচ্ছেও, অনেক ছেলে মেয়ে এ রাস্তা- ও রাস্তা ঘুরে ফাইনালি কিছুতেই স্কিল্ড হতে পারছে না।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে ইনোভেশন। সিএসই তে আপনাকে চিন্তা করতে পারা লাগবে, ইমাজিনেশন করতে পারা লাগবে, বক্সের বাইরে চিন্তা করতে পারা লাগবে। পৃথিবী কোন দিকে যাবে সেটার চিন্তা যদি আপনি না করনে তাহলে তো পৃথিবী আগাবে না।
ইনোভেটিভ না হয়েও আপনি সিএসই তে একজন পাটি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবেন তবে সেটা খুব বেশী শুখের হওয়ার কথা না। অন্তত আমার কাছে সেটা একজন ডেইলি লেবার থেকে বেশী কিছু নয়।
এই সাবজেক্ট এ ভালো করার জন্য পরিশ্রমি হতে হবে আর কিউরিয়াস মাইন্ডেড হতে হবে। কারন একটা প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট এর সময় যে পরিমান সমস্যা বের হয় সেগুলা নিজে নিজে সলভ করা লাগে। আবার একই কোড দিনের পর দিন লিখে গেলে আপনার অবস্থা হবে নোকিয়া এর মত। সবাই আগায় যাবে আর আপনি উগান্ডা যাবেন।
যদি পরিশ্রমী না হন, দিনের পর দিন লেগে না থাকেন তাহলে আর যাই হোক, এই লাইনে একজন লেবার ইঞ্জিনিয়ার এর বেশী কিছু হতে পারবেন না। লেবার ইঞ্জিনিয়ার বলতে একই কোড দিনের পর দিন যারা লিখেন তাদের বলা হয়েছে, ইনসাল্টিং ওয়েতে নয়।
এর বাইরে আরও কিছু ব্যাপার আছে কিন্তু পোস্ট বড় হয়ে যাচ্ছে। সামনে আগাই…
০৭
আমার কাছে কেউ পরামর্শ চাইতে আসলে আমি সাধারনত ডিরেক্ট ডিমোটিভেট করি। এর কারন হচ্ছে, যে ব্যাক্তি একেবারে বেসিক বিষয় গুগোল সার্চ না করে আমার কাছে জিজ্ঞেস করে, তার সেলফ কনফিডেন্ট নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
এই সন্দেহ দূর করার জন্য একটু ডিমোটিভেট করি। আবার অনেকে আছে যাদের কিছু কাজ দেই, সেগুলা না করলে ডিমোটিভেট করি। কারন পরিশ্রম ছাড়া এই সাবজেক্ট এ ভালো করা সম্ভব নয়।
এখন এতে করে অনেকে সিএসই ভর্তি হয় না। তাহলে এটা কি ভালো হয় নাকি খারাপ হয়? যারা ভর্তির পর মুভ করে তাদের কি ক্ষতি হয় না?
০৮
সেলফ কনফিডেন্ট আর পরিশ্রম ছাড়া যারা ভর্তি হয় তাদের বেশির ভাগ কিন্তু পরবর্তিতে আর ভালো করে না। এর প্রমান দেখা যায় আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এর দিকে তাকালে। দেখুন প্রতি বছর এত এত সিএসই গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে কিন্তু আমাদের সফটয়্যার ইন্ডাস্ট্রি কি সেভাবে এগিয়েছে?
আমরা কি সেভাবে কম্পিউটার এইডেড সেক্টরে আগাতে পারছি? পারি নাই। না পারার মুল কারন হচ্ছে, এই সমস্ত শিক্ষার্থী। যারা শুধু ডিগ্রি অর্জন করছে কিন্তু স্কিল এর দিক দিয়ে শুন্য, পরিশ্রম আর ইনোভেশনে যারা আন্ডা।
আমাদের ক্লাস গুলোতে কয় জন কোড লিখতে পারে? কয়জন নেটওয়ার্কিং পারে? আমি যদি জিজ্ঞেস না করে ভেরিফাই কর, অন্তত অর্ধেক শিক্ষার্থী একটা সাধারন প্রিন্ট করতে পারে না। (উগান্ডার সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো যদিও)
এই সব কিছুর উর্ধে আরেকটি বড় সত্য আছে। সেটা হচ্ছে, এভাবে মিসলিডিং ইনফর্মেশনে, এ রকম সাবজেক্ট এ পড়ার জন্য ছেলে মেয়েরা হতাশ। আমরা প্রচন্ড হতাশ একটা ইউথ সমাজ এর দিকে আগাচ্ছি।
অন্যান্য দেশে যেখানে ইউথ রা সমাজের লিড দেয়, সমস্যা সমাধান করে যেখানে আমাদের ইউথরা হতাশ হয়, আরও হতাশ হয় তার পর আরও হতাশ হয়।
এই যে হতাশ একটা ইউথ সমাজ তৈরি হচ্ছে, সেটার দায় ০২ এর মোটিভেশন, অসম্পুর্ন তথ্য দিয়ে মোটিভেশন, নিজেকে কুল ডুড প্রমান করতে দেওয়া মোটিভেশন…